আজকে আমরা জানবো সম্পূর্ণ নির্মূল অযোগ্য রোগ ডায়াবেটিস সম্পর্কে। অঘোষিত এই মরণ ব্যধি রোগ প্রতিরোধের জন্য করণীয় কি। একবার ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হয়ে গেলে করণীয় কি। নিয়মিত খাবার তালিকায় কি রাখলে ডায়াবেটিস থাকবে একদম নরমাল? এক কথায় ডায়াবেটিস কি, কেন হয়, করনীয় সম্পর্কে জানবো।
প্রতি বছর ১৯ ডিসেম্বর ডায়াবেটিস দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশে মোট জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) -এর একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। যার মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যাই প্রায় ২৬ লাখ এবং ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ। চলুন, জেনে নেওয়া যাক ডায়াবেটিস সম্পর্কে সবকিছু।
ডায়াবেটিস কি ?
একধরনের মেটাবলিক ডিজঅর্ডার হলো মূলত ডায়াবেটিস। এক্ষেত্রে দেখা যায় শরীরে ইনসুলিন থাকা সত্যেও তা কাজ করতে পারছে না। আবার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিরখেত্রে দেখা যায় ইনসুলিন একদমই নষ্ট হয়ে গেছে।
আরও পড়ুনঃ চুল ঘন করার উপায় কি?
ডায়াবেটিস কত প্রকার ও কি কি ?
ডায়াবেটিস সাধারণত চার ধরনের হয়ে থাকে। যেমনঃ
টাইপ-১ ডায়াবেটিস
টাইপ -১ ডায়াবেটিস হলো, এই ডায়াবেটিস যেমনই হোক না কেন যে ব্যক্তির একবার হয়েছে তার শরীরের সব ইনসুলিন নষ্ট হয়ে গেছে। এমন ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের আলাদা ভাবে ইনসুলিন না দিলে তারা মারা যেতে পারে, যার সম্ভাবনাই বেশি।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস
বাহিরের ফাস্টফুড খাওয়া হয়। যখন শরীরে ইনসুলিন থাকার পড়ে কাজ করে না তখন এই খাবারগুলির গ্লুকোজ জমা হয়ে যায়। এটাকে টাইপ - ২ ডায়াবেটিস বলে।
জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস
এটিকে জেন্তেশনাল ডায়াবেটিস বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসও বলে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলার কারণ, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস না থাকলেও অনেক নারী গর্ভধারণের পরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
অনেক সময় দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় রক্তে শর্করার হার বেড়ে যায়। আবার গর্বের সন্তান প্রসবের পর তা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। এটিকেই মূলত গর্ভকালীন বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলে।
অন্যান্য ডায়াবেটিস
এই ডায়াবেটিস মূলত উপরের তিন ধরনের ডায়াবেটিস ছাড়া বাকি সব ধরনের ডায়াবেটিস এই দায়াবেতিসের আওতাভুক্ত। এই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা তুলনামূলক খুবই সহজ।
আরও পড়ুনঃ বাথরুমে প্রবেশ করার দোয়া আরবি ২০২২
ডায়াবেটিস কেন হয়? লক্ষণগুলো কী?
আমাদের খাবার খাওয়ার সময় আমাদের প্যানক্রিয়াস থেকে একটা পরিমাণ ইনসুলিন নিঃসৃত হয়।এই ইনসুলিনের কাজ হলো, যে খাবার খাচ্ছি, সেটার অতিরিক্ত গ্লুকোজের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া।
যখন ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায় অথবা ইনসুলিন উৎপাদন হওয়ার পরও যখন কাজ করতে পারে না, তখন শরীরে অতিরিক্ত গ্লুকোজ জমা হয়ে থাকে। সেই অবস্থাকে আমরা ডায়াবেটিস বলে থাকি। যখন খালি পেটে গ্লুকোজের মাত্রা ৭-এর বেশি থাকে এবং ভরা পেটে যদি ১১-এর বেশি থাকে, তখন সেই অবস্থাকে ডাক্তারি দিক থেকে ডায়াবেটিস বলা হয়।
ডায়াবেটিসের টাইপ- ১ এ আক্রান্ত হলে যে কেউ খুব স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতে পারে। ডায়াবেটিস ১ এ আক্রান্ত হলে হঠাৎ স্বাস্থ্য খুব বেশি খারাপ হয়ে যায়। ওজন হ্রাস পায় খুব দ্রুত।
অন্যদিকে সমস্যা তৈরি হয় ডায়াবেটিস ২ এ আক্রান্তদের ক্ষেত্রে। এই টাইপ ২ এ আক্রান্ত ব্যক্তিরা সহজে বুঝতেই পারে না যে তারা ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
এমন আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়, বারবার প্রস্রাব করা, খাবার খেয়েও ক্ষুধা না মেটা, ক্লান্ত লাগা, ঝিম ঝিম ভাব ধরা ভাব। কোথাও কেটে গেলে বা ঘা হলে সহজে সেটা শুকাতে চায় না। এ রকম কিছু লক্ষণ থাকে। এগুলো খুব স্বাভাবিক বলেও তাঁরা চিকিৎসকের কাছে যান না। তাই তিন-চার বছরে অনেক ক্ষতি হয়ে যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের। লম্বা একটি সময় শেষে দেখা গেল, চোখে রক্ত জমেছে। হার্টে ব্লক হয়ে গেছে, যকৃতে ক্রিয়েটিনিন বেশি তৈরি হচ্ছে।
ওজনের সাথে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক কি, কেন হয়, করনীয়
ওজনের সাথে ডায়াবেটিসের সাথে সরাসরি বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক আছে এমন কথা বলা যাবে না। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের দেখা যায়, তাঁরা ফাস্ট ফুড খেতে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। শুয়ে-বসে সময় কাটায়, তাদের ওজন তুলনামূলক বেশি।
যার কারণে তাঁদের শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধক বেড়ে যায়। ফলে ইনসুলিন নিঃসরণ হলেও সেটা কাজ করতে পারে না নিজস্ব গতিতে। তাই টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা সবথেকে বেশি থাকে।
পারিবারিক সুত্রে কারর ডায়াবেটিস থাকার ইতিহাস থাকলেও জিনগত ভূমিকা বা জেনেটিক রোলের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলক বেশি থাকে।
ডায়াবেটিস এর অন্যতম কারণ হলো জিনগত ভূমিকা, এবং জীবনযাপন বা লাইফস্টাইল। বাবা-মায়ের ডায়াবেটিস আছে মানে সন্তানের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ ভাগ থেকেই যায়। অন্যদিকে জীবন যাপন যদি স্বাস্থ্যকর না হয়, সে ক্ষেত্রে বাকি ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ শতভাগ ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
ঘরে নিজস্ব কাজ, অফিসের কাজ, যা-ই থাকুক না কেন, ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। যেমন প্রতি সেকেন্ডে দুই পা হাঁটতে হবে। জোরে জোরে প্রতিদিন অন্তত আধা ঘণ্টা হাটা চলা করতে হবে।
ডায়াবেটিস হলে করব কী?
ডায়াবেটিস হলে চারটি করণীয় যা খুব ভুমিকা রাখে। মুখে সেবন করা ওষুধ, ইনসুলিন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, মানসিক সমর্থন এর সবগুলো খুবই জরুরি। ড্রাগ (ওষুধ), ডায়েট, শৃঙ্খলা (ডিসিপ্লিন)—এগুলো আরও জরুরি।
সবার উচিত নিজস্ব জীবনযাপন ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করা। এজন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। নিয়মিত চেকআপও করতে হবে ডায়াবেটিস। বাসায় গ্লুকোমিটার রেখে নিয়মিত মাপতে হবে তা। ডায়াবেটিস হওয়ার পর যদি কোনো রোগী এসব মেনে খাওয়ার আগে পাঁচ থেকে ছয় আর খাওয়ার পরে দশের নিচে ডায়াবেটিস রাখতে পারেন, তাহলে তার জন্য এটা ভালো। তিনি দীর্ঘ সময় ডায়াবেটিস নিয়ে সুস্থ থাকতে পারবেন।এছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবারের সমর্থন থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
ডায়াবেটিস হলে যেসব ফল খাওয়া উপকারীঃ
ডায়াবেটিকস হলে দাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খেতে হবে। পাশাপাশি পিচ ফল, জাম, আপেল, পেপে এবং পেয়ারা খেলে বেশ ভালো উপকার পাওয়া যাবে। কারণ এসব ফলে উপস্থিত বিভিন্ন রকমের ভিটামিন যা ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত রোগীর জন্য বড় রকমের সুস্থতা নিয়ে আসতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুনঃ মুসলিম মেয়েদের ইসলামিক নাম অর্থসহ তালিকা ২০২২
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য যে ফল খাওয়ান উপকারী, ফলগুলির ভুমিকা সম্পর্কেঃ
পিচ ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিন সি, ভিটামিন এ ও পটাশিয়াম বিদ্যমান। যা ডায়াবেটিস হলে শরীরে যেসব সমস্যা হয় সেসবের বিরুদ্ধেও লড়াই করে পিচ ফলে থাকা বায়ো অ্যাকটিভ যৌগ উপাদান। পিচ ফল নিয়মিত খেলে শরীরের প্রদাহ কমে, বাড়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও। সেইসঙ্গে উন্নত হয় খাদ্য হজম শক্তির।
জাম ফলটি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসের প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলটিতে শর্করার পরিমাণ থাকে তুলনামূলক অনেক কম। যে কারণে প্রতিদিন জাম খেলেও তা রক্তে শর্করার পরিমাণ একবিন্দু বাড়ায় না। জামে থাকা যৌগ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট স্টার্চকে শক্তিতে রূপান্তর করতে সবসময় সাহায্য করে। একইসাথে জাম ফল রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখতে সর্বদা কাজ করে।
আপেল হলো ফাইবারসহ নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ খুব উপকারী একটি ফল।আপেল ডায়াবেটিস রোগীর জন্যে অতন্ত উপকারী একটি ফল।
আপেলে ফ্রুক্টোজ কম এছাড়া এটি দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় উভয় ফাইবারে পূর্ণ। যে কারণে আপেল খেলে তা কোষ্ঠকাঠিন্য কমে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য পেট ভরিয়ে রাখতে ভুমিকা রাখে করে। আপেলে থাকা ফাইবার হজম প্রক্রিয়া এবং চিনির শোষণকেও ধীর করে রাখে। এতে চিনি ধীরে ধীরে রক্তের প্রবাহে প্রবেশ করতে পারে। যে কারণে বাড়ে না রক্তে শর্করার পরিমাণ।
পেঁপে মানব দেহে রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে কাজ করে। শরীরে হাইপোগ্লাইসেমিক প্রভাব ফেলতে পারে পেঁপে। এতে আছে ফ্ল্যাভোনয়েড। যার মাধ্যমে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হয়ে থাকে। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সবসময় কাজ করে। পেঁপেতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষের ক্ষতি প্রতিরোধ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
পেয়ারায় ক্যালোরি অনেক কম এবং এটি ফাইবার সমৃদ্ধ। পেয়ারা খেলে তা ধীরে ধীরে হজম হয়। এছাড়া শরীরের কোষ দ্বারা ধীরে ধীরে শোষিত হয় পেয়ারা। রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায় না। পেয়ারায় কমলার তুলনায় চার গুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। এতে পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের মাত্রা অনেক বেশি থাকে। এসব উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি অনেক অসুখের ঝুকি কমায়।
সর্বোপরি, ডায়াবেটিস একবার হলে সম্পূর্ণ নির্মূল করা এখন পর্যন্ত সম্ভব না। তবে নিয়মিত ট্রিটমেন্ট এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়।
আশা করছি আজকে আপনাদেরকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সবকিছু স্পষ্টভাবে বোঝাতে পেরেছি। এই পোস্টের পরে ডায়াবেটিকস নিয়ে আর কোনো ভুল ধারণা বা অজ্ঞতা থাকবে না।
নিত্য নতুন এমন লেখা পেটে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে এবং কানেক্ট থাকুন আমাদের ফেসবুক পেজে।
0 মন্তব্যসমূহ